মুক্তিকামী জনতার বিজয় অবশ্যসম্ভাবী

কারাবরণ দোষের কিছু নয়। যুগে যুগে নবী-রাসূল থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধানের নানা কারণেই কারাবরণের ইতিহাস অনেকেরই জানা। সূরা ইউসুফের ৩৬ নং আয়াতে হজরত ইউসুফ আ:-এর কারাগারে প্রেরণের তথ্য জানতে পারি। যদিও সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে তার এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত করে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কারাগার থেকে বের হন।
পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মানুষ প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিয়াবে আবু তালিবের দীর্ঘদিনের নির্মম কারাবরণ রাসূল (সা)-এর জীবনের অন্যতম অংশ। ইমাম আবু হানিফা রহ:সহ পৃথিবীর হাজারো আলেমের কারাবরণ ইসলামী ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বিশ্বকাঁপানো শক্তিধর অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের নামে পাওয়া যায় কারাবরণের ইতিহাস। সাউথ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা একসময়ের প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৬২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবরণ করেন, যিনি ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বেশ প্রশংসিত হন তিনি। দীর্ঘ তিন দশক পর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়া মিসরের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির অমানবিক কারাবরণ সমগ্র বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়। ৩০ জুন ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই ৩ জুলাই ২০১৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন ও কারাগারে আটক হন মুহাম্মদ মুরসি। তিনি এখনো কারাগারে জীবন কাটাচ্ছেন।
কারাগারে অসহনীয় দিনাতিপাত করেন কিউবার আলোচিত প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো। ১৯৩০ ত্রিশালে কারান্তরীণ হন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী। মিখাইল গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ’৯০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাকে ১৯৯১ সালে গৃহবন্দি করা হয়েছিল।
এ ছাড়াও ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমাট, থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা, নিকারাগুয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট Arnold এলেমান, ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী পাবলো লেজারেস্কো, পেরুর প্রেসিডেন্ট Alberto Fujimori, চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাও জিয়াং, জাপানের তুজু হি তে কি, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি রুহ তায়ে-ও, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী কুইসলিং ভিডকুন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধান Pitail Philips, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহ মোহাম্মদ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী মুসোলিনি, আর্জেন্টিনার Maname কার্লোস, তুরস্কের আদনান Man Daraz, ব্রাজিলের Lola D Silva, ইরানের প্রধানমন্ত্রী আমির আব্বাস হুবেদা, জার্মানির এরিখ হোনেকার, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, নেপালের শের বাহাদুর দেউবা, বাংলাদেশের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ আরো প্রায় শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান সময়ের পরিবর্তনে কারাবরণ করেছেন।
এই কারাবরণ নানাবিধ কারণে হলেও অধিকাংশ কারাবরণের পরিণতি সেই দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীন হওয়া। সেখানে গণতান্ত্রিক ধারা অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকারের প্রতিটি অঙ্গ স্বৈরাচারের সেবাদাসে পরিণত হয়। সে দেশের বিচারব্যবস্থা সরকারের সুরক্ষা সেন্টারে পরিণত হয়। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যক্তিগণ সরকারের ভয়ে ভীত হয়ে একটা অংশ নিষ্ক্রিয় থাকলেও অধিকাংশ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সরকারি তোষামোদি বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। বিভিন্ন বাহিনী সরকারি রক্ষীবাহিনী হিসেবে বাড়িত হতে থাকে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে দুর্নীতির সয়লাব হয়ে যায়। কিন্তু সরকারকে তার ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য কথা বলার জন্য কোনো ব্যক্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। সবাই শুধু সরকারের তোষামোদে ব্যস্ত থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রপরিচালনায় নিজের ভুলগুলো কোনো শক্তি আর উপলব্ধি করতে পারে না। ভয়ানক জনবিচ্ছিন্ন কর্মসূচিতে নিজেদের সর্বদা ব্যস্ত রাখেন সে রকম সরকার। ব্যক্তি হিসেবে সরকারপ্রধান নিজেকে সকল ভুলের ঊর্ধ্বে ভাবতে থাকেন। জনগণের কোনো অংশ তার ভুল জনসম্মুখে তুলে ধরতে চাইলে তিনি সেই জনগণকে তার শত্রু ভাবতে থাকেন, স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্মম নির্যাতনের সুযোগ করে দেন।
পেরু একটি শান্তিপ্রিয় দেশ। সে দেশের ৪৫তম রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফুজি মরিকে সে দেশের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দুর্নীতিবাজ সরকার স্বৈরশাসক শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিউনিসিয়ার বিদায়ী রাষ্ট্রপতি জিনে আল-আবেদিনে বিন আলি দীর্ঘ ২৩ বছর স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। ১৯৮৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি তার কোনো বিরোধী শক্তিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেননি। সামরিক শক্তির প্রেরক তিউনিসিয়ার দ্বিতীয় এই প্রেসিডেন্ট পৃথিবীর অন্যতম স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত। গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর কলঙ্কের ইতিহাস দীর্ঘ ৩২ বছর। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩২ বছর বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতায় থাকেন মবুতু শেশে কুকু। সেনাসমর্থনে ক্ষমতায় আসা দুর্নীতিবাজ শাসককে আফ্রিকার বিগম্যান বলা হয়। ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি মো: সুহার্তো ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর স্বৈরশাসক হিসেবে রাষ্ট্রপরিচালনা করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত হয়ে অবশেষে জনরোষের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো নিজের স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে বিরোধীদলীয় নেতা লিউপপ লোপেজকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষেপ করেন। যদিও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পরবর্তীতে এ মামলাটিকে সাজানো বলে উল্লেখ করেন। মিয়ানমারের Military janta অং সান সু চিকে ১৯৯০ সালে বিজয়ের পরও ক্ষমতায় বসতে দেয়নি বরং কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচারী সরকারই ক্ষমতায় ছিল। উত্তর কোরিয়ায় প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধী দল নেই। তবুও কিম জন উন মনোভাব থেকে তার নিজ দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি জ্যাং সং থায়েক, যিনি তার আপন চাচা তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
এ ছাড়াও উগান্ডার প্রেসিডেন্ট তার বিরোধী দলের প্রধানকে কারাগারে রেখে নির্বাচন করে বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, কম্বোডিয়ার হান মেন, মিসরের হোসনি মোবারক তাদের বিরোধী দলকে কারাগারে রেখে স্বৈরাচারী আচরণ করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশে নব্য স্বৈরাচারের সূত্রপাত হয় ২০০৬ সালে সেনাসমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বর্তমান সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের ভিতকে মজবুত করতে সর্বজনস্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিলের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনাভোটে নির্বাচিত এমপি হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে পাকাপোক্ত স্বৈরতন্ত্রের পথে আরো একধাপ এগিয়ে যায় গণবিচ্ছিন্ন আওয়ামী সরকার। স্বৈরতান্ত্রিক পথের কাঁটা সরাতেই ইতোমধ্যে সরকার যুদ্ধাপরাধের ঠুনকো অজুহাতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করেন অন্যতম শীর্ষ বিরোধীদলীয় নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলীসহ অনেক নেতাকর্মীকে। গুম খুন আর মিথ্যা মামলায় কারাগারে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে গণতন্ত্রকামীদেরকে ।
স্বৈরশাসক হিসেবে বর্তমান সরকার তার চেহারার কুৎসিত রূপ তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অপসারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করে স্বৈরতন্ত্রে আরো একটি পথের কাঁটা সরিয়ে দেন এই সরকার। অসহায় বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইকারী প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সাজা প্রদানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে তালাবদ্ধ করে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত যাত্রা নিশ্চিত করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অন্যায়ভাবে খালেদাকে গৃহচ্যুত করা হয়েছে। নবরূপে বাকশাল নিশ্চিত করতে স্বৈরতন্ত্রের পথকে নিষ্কণ্টক করতে বিরোধী জোটের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার ছেলে তারেক রহমানকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে জামিনে খালেদা জিয়ার মুক্তির সুযোগ থাকলেও মুক্তির সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ইতোমধ্যে কুমিল্লার তিনটি হত্যা মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। খালেদা মুক্তি আন্দোলনে ঠুনকো, নিরীহ কর্মসূচি থেকে প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মী রাস্তায়Ñ স্পষ্টতই জানান দেয় বর্তমান সরকার পৃথিবীর অন্যতম স্বৈরাচারী সরকারে রূপ নিতে যাচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাস হবে হোসনি মোবারকের ইতিহাস, শেখ হাসিনা হবে এশিয়ার রবার্ট মুগাবে। বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ স্বৈরশাসকের দেশ। তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিশ্বের সকল স্বৈরশাসকের পতন শুরু হয়ে আজ তা বিলুপ্তির পথে। ৩০ থেকে ৪০ বছর ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসকগণ আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না ইনশাআল্লাহ। মুক্তিকামী জনতার বিজয় অবশ্যসম্ভাবী।

মন্তব্য